August 17, 2025, 12:09 am

ব্যবসা নিভু নিভু ॥ ছন্দহীন তবলার কারিগরেরা

ব্যবসা নিভু নিভু ॥ ছন্দহীন তবলার কারিগরেরা

কমল সেনগুপ্ত ॥

‘বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা আগের মত নেই। দোকানভাড়া তুলতেই হিমশিম অবস্থা এখন। একসময় প্রতিমাসে পাঁচ ছয় জোড়া তবলা তৈরীর অর্ডার থাকতো এখন কোন মাসে ২/১ জোড়া, কোন মাসে অর্ডারই থাকেই না। বরিশালে আগে সম্ভ্রান্ত, রুচিশীল, শিক্ষিত মানুষের বাসা বাড়িতে ও স্কুল কলেজে বাজনার চর্চা হতো। গ্রামগঞ্জে, নাটক, জারি গান, পালাগান অনুষ্ঠিত হতো। এখন এসবের চর্চা কমে গেছে। তাই, বাদ্যযন্ত্রে ব্যবসা এখন ভালো না, মন্দা। আর কিছুদিন পর হয়তো এ ব্যবসা আর থাকবে না’। তবলার ফিতা (দোয়ালি) কাটতে কাটতে হতাশার সুরে কথাগুলো বললেন বাজার রোডের বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ী ও কারিগর শম্ভু দাস। তিনি মূলত দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের তৈরি করে বিক্রি করেন প্রতিষ্ঠানের নাম ‘তবলা ভুবন’। পুরোনো রঙ ওঠা ময়লা সাইনবোর্ড। দোকানে একটি মাত্র টিউব লাইট জ্বলছে। শম্ভু দাসের সাথে কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম একসময় বাদ্যযন্ত্রের রমরমা ব্যবসা থাকলেও এখন তা যেন নিভু নিভু।

তবলা একটি ঐতিহ্যবাহী দেশীয় বাদ্যযন্ত্র যা সাধারণত সংগীতে ব্যবহার হয়। যারা তবলা বাজায় তাদেরকে ‘তবলচি’ বলা হয়। বাদক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গানের সাথে তালের মিল রেখে বাজিয়ে থাকেন। তবলা (ডাহিনা) ও বায়া। এক সাথে বায়া তবলা। বাঁয়া বাম হাতে বাজানো হয়। তবলা ডান হাতে। তবলা কাঠের তৈরি হয়ে থাকে এবং বাঁয়া মাটির বা ধাতব বস্তুর দিয়ে তৈরি। তবলা তৈরির জন্য প্রয়োজন এক খন্ড গোলাকার নিম কাট। নিম কাঠ ঘুনে ধরে না। গোলাকার কাঠখন্ডকে লেদ মেশিনের সাহায্যে ভেতর ফাঁপা করে উপরের অংশ চামড়া দিয়ে ছাউনি দেয়া হয়। গোলাকার ধাতব বা মাটির অংশে চামড়ার ছাউনি দিয়ে তৈরী হয় বায়া। তবে মাটির বায়া এখন আর দেখা যায় না। তবলা ও বায়ার উপরের অংশকে ছাউনি বলা হয়। ছাউনির উপরে কালো অংশকে খিরন, চামড়ার দড়ির নাম দোয়ালি। তবলায় আটটি গুটি থাকে। তবলচি গুটির সাহায্যে দোয়ালি টেনে প্রয়োজনমত ছন্দের পরিবর্তন করেন। ছাউনির চারপাশের আধা ইঞ্চি পরিমাণ অংশকে বলা হয় কানী। তবলা তৈরি হলে খরের সাথে কাপড় পেঁচিয়ে তৈরি হয় বৃত্তাকার বিরা। বায়া তবলা বিড়ার উপরে রেখে বাজানো হয়। শম্ভু দাস জানায়, ‘একজোড়া তবলা তৈরি করার জন্য নিম কাঠের অংশ মানিকগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করা হয়। আর বায়ার গোলাকার ধাতব অংশ কেরানীগঞ্জে পাওয়া যায়।

প্রক্রিয়াজাতঃ চামড়া আসে নাটোর/রাজশাহী থেকে। একজোড়া তবলা তৈরি করতে প্রায় ১০ দিন সময় লাগে। শম্ভু দাস বলেন ‘দোকানটি ৬০-৭০ বছরের পুরনো। তার বাড়ি টাঙ্গাইল। আত্মীয়তার সূত্রে বরিশালে আসা। তবলা তৈরি তার তিন পুরুষের ব্যবসা। এক জোড়া বায়া-তবলা সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। চামড়া কাঠসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী জোগাড় করতে অনেক খরচ পড়ে হয়। অতীতে প্রতিদিন নতুন বাদ্যযন্ত্র বিক্রি ও সারাইয়ে গড়ে দু-আড়াই হাজার টাকা আয় হতো, সেখানে তা কমে এখন শতকের ঘরে নেমে এসেছে। কোনদিন শুন্য হাতেই ঘরে ফিরতে হয়’। বায়া-তবলা ছাড়াও শম্ভু দাস তৈরি করেন ঢাকঢোল, ডুগডুগি, খোল প্রভৃতি চামড়া দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র। তিনি জানান, ‘শখ করে কেউ কেউ ডুগডুগি কিনতে আসেন লোকসংগীত এর জন্য। লোকজ ধারাকে প্রদর্শনের ধরে রাখতে’। জানতে চাইলাম হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা আসছে ঢাকের অর্ডার পেয়েছেন? আবার হতাশার সুর শম্ভুর কন্ঠে। তিনি বলেন, ‘দুর্গাপূজায় এখন আর ঢাকের তেমন চাহিদা নেই। এখন সবাই চায় ইলেকট্রিক সাউন্ড সিস্টেম। সাথে সাউন্ড বক্স। দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমণ্ডিত বরিশাল শহরে হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, গিটার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের বেচাকেনা আর আগের মতো নেই। আধুনিক ইলেকট্রিক বাদ্যযন্ত্রের দাপটে সনাতনী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসায় মন্দা চলছে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের চর্চা কমে যাওয়ায় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসারও রাশ টেনে ধরেছে।

বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুতকারকদের বাজারে মন্দা চলছে। বিভিন্ন কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে প্রধান হল- শিখতে নতুন প্রজন্মের আগ্রহের অভাব, এবং প্রযুক্তিনির্ভরতার বৃদ্ধি। কথা হল বরিশাল বেতারের তবলা বাদক চন্দন দাসের সাথে। চন্দন জানালেন, কোচিং সেন্টার দৌড়ঝাঁপের কারনে শিশু-কিশোররা তবলা শেখার সময় পায় না। কেউ শখ করে তবলা কিনলেও কিছুদিন শিখে বন্ধ করে দেয়। অব্যবহৃত অবস্থায় তবলায় ত্রুটি দেখা দেয়। ত্রুটি দেখা দিলে কেউ আর তবলা মেরামত করে না। এখন এক জোড়া বায়া-তবলা মেরামত করতে প্রায় ২ হাজার টাকা লাগে। এছাড়াও বাসায় গিয়ে তবলা শেখাতে একজন শিক্ষককে মাসে ২ হাজার টাকা দিতে হয়। চন্দন আক্ষেপ করে জানালেন, ‘শহরের হাসপাতাল রোডে স্বরলিপি সঙ্গীত বিদ্যালয় নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে তবলা শেখার বিভাগ আছে কিন্তু শিক্ষার্থী পাওয়া দুষ্কর। ২/১ জন শিক্ষার্থী পাওয়া গেলেও তারা তবলা বাজানোর ব্যাকরণ শিখতে চায় না। অনেকেই এখন মোবাইলে সাউন্ড সিস্টেম সেট করে গান গায়’।

ঐতিহ্যবাহী এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ বরিশাল শহরে এখন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা কমছে। দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের এমন করুণ অবস্থা দেখে অনেকে বলছেন এটা বিলুপ্তির পথে। শম্ভুর কাছে জানতে চাইলাম, তিনপুরুষের এই ব্যবসা ধরে রাখতে চান? প্রশ্ন শুনে নির্বাক হয়ে গেলেন তিনি। চোখে মুখে এক আকাশ হতাশা। চোখ ফিরিয়ে তাকালেন ময়লা জমা পুরনো টিউব লাইটের ছন্দহীন আলোর দিকে। ঠোট কুঁচকিয়ে বোঝালেন ছন্দ হারিয়ে ফেলেছেন তিনিও। বুঝলাম বায়া-তবলার ব্যবসা এখন ছন্দহীন, তাল-লয়হীন পড়ছে। কিছুদিন পরে হয়ত চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে ফুটন্ত পানিতে দু’মুঠো চাল ফেলা মুশকিল হয়ে যাবে ওদের।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © All rights reserved © 2024 DailyBiplobiBangladesh.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com